জীবন সংগ্রাম | আমিনুর রহমান | পর্ব - ৩
অনেকটা সময় পরে বড়সড় একটা বাড়ির সামনে গিয়ে মাইক্রোটা থেমে পড়ল। আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তবুও নিজের ভিতরে কিছুটা কৌতুহল কাজ করছিল। যে লোকটা আমাকে ধরে আনল সে কি আমার উপকার করতে চায় নাকি ক্ষতি করতে চায়। এই জিনিসটা আমার মস্তিষ্কের নিউরনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো প্রতিনিয়ত। আমি লোকটাকে দেখার জন্য স্বভাবতই উত্তেজিত হচ্ছিলাম। কিন্তু যখন মানুষটাকে আমি দেখলাম তখন নিজের অজান্তেই আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমি যেনো নিজেকে বিশ্বাসই করাতে পারছিলাম না এই মানুষটা আমাকে ধরে এনেছে। হ্যাঁ আমার বাবা আমাকে ধরে এনেছে। ধরে আনার অবশ্য কারণও আছে। কারণ সে খুব ভালো করেই জানত তাঁর ডাকাতে আমি আসতাম না। তাই এমনভাবে আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে এসেছে। ওনি প্রথমটা কথাটা বলল।
তোমাকে এভাবে আনার জন্য আমি দুঃখিত। তবে এভাবে ধরে নিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এই পদ্ধতি বেছে নিতে হয়েছে আমাকে।
- আমাকে এভাবে নিয়ে আসার কারণ কি?
- তুমি আমার একমাত্র সন্তান। তোমাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিলো। আরও কিছু কারণ আছে।
- আচ্ছা,আজকে মনে হচ্ছে আপনার সন্তান আমি? আর যেদিন আমাকে গ্রামে একা রেখে চলে এসেছিলেন সেদিন কি মনে ছিলো না আমি কে? কি আমার পরিচয়? আপনি তো সেদিন চিৎকার করে বলেছিলনে আমি আপনার সন্তান নই,আমি অন্য কারো সন্তান। আপনি আমাকে স্বীকার করতে চাননি। তবে আজ কেনো এতো সহানুভূতি দেখাচ্ছেন? কারণ কি?
- কোনো কারণ নেই। তুমি আমার সন্তান। তুমি আমার সাথে থাকবে আজ থেকে। আমার সহায়সম্পত্তি যা কিছু সবই তোমার। এসবের একমাত্র উত্তরাধিকার তুমি।
- কিন্তু আমি তো এতো টাকা-পয়সা ওয়ালা বিলাসবহুল কোনো জীবন চাইনি। আমি চেয়েছিলাম আপনাদের দুজনকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে একটু তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বেঁচে থাকতে। কিন্তু আপনারা কি করলেন? আপনারা নিজেদের সুখের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।
- ওই মহিলার কথা তুমি ভুলে যাও। আজ থেকে তুমি তোমার নতুন মায়ের সাথে থাকবে এবং তাকেই মা বলে ডাকবে।
- যেখানে আপনার সাথে দেখা হওয়ার পরে একবারও বাবা ডাকলাম না সেখানে যে মহিলাটা আমার মায়ের সংসারটা ভেঙে দিয়েছে তাকে কিভাবে মা ডাকব? আর আপনি ভাবলেনই বা কি করে এরকম একটা মহিলাকে আমি মা ডাকব? আমি হয়তো চাইলেই কাউকে বাবা কিংবা মা ডাকতে পারব না কখনো। কারণ এই ডাকটার প্রতি আস্তে আস্তে কচ্ছপ গতিতে আমার ভিতরটাতে অনেকটা ঘৃণার তৈরি হয়েছে।
- ঘৃণাটাকে ভালোবাসায় পরিণত করো। তোমাকে বিলাসবহুল চিন্তাহীন একটা জীবন উপহার দিতে চেয়েছি,আমি এখানে বাবা হিসেবে সফল।
- না আপনি কখনোই বাবা হিসেবে আদর্শ বাবা ছিলেন না। আপনি শুধু নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করেছেন সবসময়। আপনার কাছে যেখানে একহাজার টাকা চাইলে আপনি দিতে হাজারবার চিন্তা করতেন সেখানে আজকে আমাকে বিলাসবহুল জীবন উপহার দিতে চাচ্ছেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে বড় কোনো কারণ আছে?
- হ্যাঁ কারণ আছে তবে সেটাতেও তোমার ভালো নিহিত।
- তো কি কারণ আর কেমন ভালো নিহিত?
- একটা সুন্দরী মেয়েকে তোমার বিয়ে করতে হবে।
- আমি বিয়ে করলে আপনার লাভ কি?
ওনি আর আমার কোনো কথার উত্তর দিলেন না। ওনি একটা মহিলাকে আমার সামনে নিয়ে এসে বললেন।
"ওর নাম আয়েশা। আজ থেকে তুমি ওকে নিজের মায়ের মতো দেখবে এবং মা বলে ডাকবে। ও চেয়েছে বলেই আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি।"
বাবা নামক মানুষটার ছুঁড়ে দেওয়া কথাগুলোর বিপরীতে আমি বললাম।
"মায়ের মতো দেখব তবে মা বলে ডাকব না কখনোই। কারণ আমি নিজের মাকেই মা বলে ডাকতে ঘৃণা করি সেখানে এই মহিলাকে মা ডাকার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। আর এখন তো ক্লিয়ার হলো আপনি নিজের ইচ্ছে তে আমাকে এখানে নিয়ে আসেননি। আপনার বউ চেয়েছে তাই নিয়ে এসেছেন। আবার যখন আপনার বউ চাইবে আমাকে বের করে দিবেন।"
আমার কথাগুলো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মহিলাটা বলে উঠল।
"তুমি ভুল বুঝছো বাবা। হ্যাঁ আমি মানছি আমি তোমার মায়ের সংসার ভেঙেছি। তবে আমি সত্যিই জানতাম না তোমার বাবার সংসার আছে,সন্তান আছে। আর যখন জানতে পেরেছি তখন আমি চেয়েছি সে আমার সাথে থাকুক সবসময়। আর তোমার মায়ের ব্যাপারটাও আমি জানতাম না। আর সেও তো অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে৷ হয়তো ভালোই আছে। তাহলে কেনো দোষটা শুধু তোমার বাবার ঘাড়ে দিচ্ছো?"
এই মহিলার কথাগুলো যৌক্তিক হলেও আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো তাঁর কথাগুলো শুনে। তারপরও আমি বললাম।
"আমি এতকিছু জানি না,আর জানতেও চাই না। আপনি আমার মায়ের সংসার ভেঙেছেন এটাই সত্যি। আর ওনি বিয়ে করেছেন সেটাও সত্যি। আপনারা সবাই সবার মতো করে নিজেদের ভালো থাকাটাকে বেছে নিয়েছেন। আমাকেও আমার মতো করে নিজের ভালো থাকাটা বেছে নিতে দিন। আমি ভালো থাকতে চাই,সুখে থাকতে চাই। আর আমি জানি আপনাদের সাথে আমি কখনোই ভালো থাকতে পারব না। কাজেই আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন।"
আমার কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই বাবা বলে উঠলেন।
"তুমি পাগল হয়ে গেছো। আমি জীবনে একটা ভুল করেছি৷ দাম্পত্য জীবনে মানুষের এমন হয়। ডিভোর্স,একাধিক বিয়ে এসব অনেকের জীবনে না চাইতেও চলে আসে। তুমি আমার ছেলে তাই আমি তোমাকে সব খুলে বলতে পারব না। তোমার মায়ের কাছে আমি কখনোই মানষিক শান্তি পেতাম না। কিন্তু এই মানুষটার কাছে আমি মানষিক শান্তি পেতাম। তাই তোমাদের ছেড়ে আমি তাকে বিয়ে করেছি। আর আমি মনে করি তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। এই বয়সে মানুষের বাবা মায়ের আদর দরকার হয় না। দরকার হয় টাকাপয়সার। আমি হয়তো তোমাকে বাবার আদর কখনো দিতে পারিনি,ভবিষ্যতেও হয়তো পারব না। কিন্তু আমি তোমার চাহিদার কোনো কমতি রাখব না। তুমি আমাদের সাথে থাকবে এটাই ফাইনাল। তোমার ভালো না লাগলেও আমাদের সাথেই থাকতে হবে৷ বাবা হিসেবে এটুকু জোর আমি তোমার ওপর করতে পারি সেই অধিকার আমার আছে।"
কথাগুলো বলেই ওনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একজন বয়স্ক লোক এসে আমাকে কিছু দামি কাপড়চোপড় দিয়ে বললেন।
"সাহেব আপনি এগুলো পড়ে নিন।"
বুঝলাম এসব কাপড়চোড় আমার জন্য আগেই ক্রয় করে রাখা হয়েছিল। হয়তো যখন তারা বুঝতে পেরেছে তাদের এতো সহায় সম্পত্তির কোনো উত্তরাধিকার নেই তখন তারা আমার কথা ভেবেছে। কারণ হাজার হলেও আমি তাঁর সন্তান। সে চাইবে অন্য কেউ এসবের মালিক হওয়ার থেকে আমি যেনো ভবিষ্যতে এসবের মালিক হই। এতো বড় বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু আমার কিছু করারও ছিল না। আমি চাইলেও এখান থেকে যেতে পারব না। তবে আমি দেখতে চাই তারা একটা মানুষকে কতদিন জোর করে তাদের কাছে রাখতে পারে। আমি দেখতে চাই কতদিন তারা আমার ঘৃণা সহ্য করতে পারে।
আমার সবসময় ইচ্ছে ছিলো নিজে কিছু করব। সেই আশা নিয়েই গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমিয়েছিলাম। ছোটোখাটো একটা চাকরি দিয়ে নিজের কর্মজীবনের প্রাথমিক অধ্যায়টা শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো এভাবেই আস্তে আস্তে কোনো একদিন বড় হবো আমি। বাবা মা ছাড়াও যে জীবনে বড় কিছু হওয়া যায় করে দেখাবো। কিন্তু আজকে মনে হলো সেই সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে গেলো। মানুষ সাধারণত অভাবের মাঝে বড় হলে,জীবনে টাকাপয়সার অভাব অনুভব করলে তারা একটা সময় বিলাসবহুল জীবন না পাওয়ার জন্য আফসোস করে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি অভাবের মধ্যে দিয়ে বড় হলেও বিলাসিতার প্রতি আমার কখনো ওরকম লোভ ছিলো না। আমি চাইতাম সাদাসিধে ভাবে খেয়ে পড়ে কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে একটু সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকতে,এর বেশি কিছু কখনোই চাইনি আমি।
তবে না চাইতেও যেহেতু আমি এরকম একটা বিলাসবহুল টাকাপয়সা ওয়ালা জীবন পেয়ে গিয়েছি সেটা আমি নিজের জন্য না হোক কিছু মানুষের জন্য কাজে লাগাতে চাই। কিছুক্ষণ পরে যখন ওনারা দুজন আমার সামনে আসলেন তখন আমি তাদেরকে বললাম।
"আমি আপনাদের সাথে থাকতে পারি আপনাদের সন্তান হয়ে। তবে আমার কিছু শর্ত আছে যেগুলো আপনাদেরকে মেনে নিতে হবে। যদি পারেন তাহলে আমি আপনাদের সাথে থাকব।"
আমার কথার প্রতিউত্তরে মহিলাটা বলে উঠলেন।
"তোমার সব শর্তই মানব। বলো কি কি করতে হবে আমাদের?"
আমি বললাম।
"আমি আপনাদের কাছে যখন যা চাইবো তাই দিতে হবে। হোক সেটা টাকা পয়সা কিংবা বাড়ি গাড়ি।"
তখন মহিলা টা বললেন।
"আমাদের যা কিছু এসব তো একদিন তোমারই হবে। চাওয়ার কি হলো? তোমার যখন যতো টাকা লাগবে আমাদের কাউকে বলতে হবে না। তুমি নিজ থেকেই যাতে নিতো পারো সেই ব্যবস্থা করে দিব।"
আমি তাঁর কথা শুনে অবাক হলাম তারপর বললাম।
"আমি টাকা দিয়ে কি করব কিংবা কি করলাম এসব কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। আর আমি নিজের ইচ্ছে মতো জীবনযাপন করব। আমি চাকরি করব নাকি করব না সেটাও আমার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। যদি আমার ইচ্ছে হয়,ভালো লাগে তাহলে আমাকে চাকরি করতে দিতে হবে।"
আমার সব কথা ওনারা মেনে নিলেন। তারপর আমি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য বললাম।
আমার পাঁচ লক্ষ টাকা লাগবে এখন।"
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাবা বলে উঠলেন।
"এতো টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?"
বাবার কথা অগ্রাহ্য করে মহিলাটা বললেন।
"আচ্ছা আমি ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি,সে তোমাকে চেক দিয়ে দিবে।"
আমি পাঁচ লক্ষ টাকার চেক নিয়ে মনের সুখে ঘুরতে লাগলাম। সারাদিন ঘুরলাম। যেখানে অসহায় পথশিশু দেখতে পেলাম সেখান থেকে তাদেরকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে ভালোমন্দ খাওয়ালাম। এভাবে সারাদিনই পথশিশুদের খাওয়ালাম। আমি চেয়েছিলাম সবগুলো টাকা খরচ করব। আমার সবসময় ইচ্ছে করত অসহায় মানুষের জন্য কিছু করব। তাদের কে মাঝেমধ্যে পেটভরে ভালোমন্দ খাওয়াবো। তাই আজ যখন সুযোগ পেলাম সেটা হাতছাড়া করলাম না। যখন বাসায় গেলাম তখন রাত দশটা বাজে। দেখলাম তারা দুজন টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। বুঝতে পারলাম তারা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আমি তাদেরকে বললাম।
"আমি বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছি।"
তারা কি বলল সেটা শোনার প্রয়োজন মনে না করে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠলাম অনেকটা দেরি করে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সোজা বাহিরে চলে গেলাম। বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন দেখলাম একটা নীল রঙের মাইক্রো বাড়ির সামনে এসে থামল। মাইক্রো থেকে আকাশী রঙের শাড়ি পড়া একটা সুন্দরী মেয়ে নেমে সোজা বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। এই মেয়েটাকে মনে হয় আগে কোথাও দেখেছি আমি। অনেক চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছি সেটা মনে করতে পারছি না।
চলবে..................
পর্ব_৩
জীবন_সংগ্রাম
আমিনুর রহমান
0 Comments