জীবন সংগ্রাম আমিনুর রহমান পর্ব - ৪ 


#জীবন_সংগ্রাম

#পর্ব-৪

# আমিনুর রহমান 


ইচ্ছে ছিলো আজকেও নিজের মতো করে সারাদিন বাহিরে ঘুরব। কিন্তু মেয়েটাকে দেখার পর সেই ইচ্ছেটা অনিচ্ছায় পরিণত হলো। মেয়েটাকে খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে হলো। তাই নাস্তাটা সেরে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলাম। ভিতরে গিয়ে দেখলাম মেয়েটা সোফায় বসে আছে। তাঁর সামনে আবার আমার বাবা আর নতুন মা বসে আছেন। মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখিনি তারপরও কেনো এমন মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। তবে শুনেছি এরকম মাঝেমধ্যে হয়,জীবনে প্রথম দেখা মানুষকে দেখেও মনে হয় আগে কোথাও দেখেছি মানুষটাকে। এই মেয়েটার ক্ষেত্রেই এমন মনে হচ্ছে আমার। কি সুন্দর মায়াবী মুখ,কি সুন্দর চাহনি। আমি মেয়েটার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তখন কারো কথায় হুঁশ ফিরল আমার। আমাকে এভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটাকে লক্ষ্য করে আয়েশা বেগম মানে আমার নতুন মা বললেন।


"ওর নাম নাদিয়া। আমার বোনের মেয়ে। ওর কথায় আমরা তোমাকে বলেছিলাম। লক্ষী একটা মেয়ে। তুমি ওর সাথে কথা বলো।"


উপরের কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে আমাকে আর অপরিচিত মেয়েটাকে রুমে রেখে তারা দুজন বাহিরে চলে গেলেন। অজানা অচেনা একটা মেয়েকে কি বলব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তাই চুপ করে বসেছিলাম মেয়েটা কখনো নীরবতার দেয়ালটা ভেঙে আমাদের মাঝে কথা বলার অধ্যায়টা শুরু করবে। কিন্তু মেয়ে কোনো কথা বলল না,সেও আমার মতো চুপ করে বসে রইলো। দুজনেই অনেকটা সময় চুপ করে রইলাম। পরক্ষণেই মনে হলো এতোটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যদি মেয়েটার সাথে কথা না বলি তাহলে হয়তো তাকে অপমান করা হবে। তাই সকল ভয়কে জয় করে আমি প্রথম কথাটা বললাম।


"কেমন আছেন আপনি?" 


মেয়েটার সরল সহজ উত্তর। 


"আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি,আপনি কেমন আছেন?"


আমিও শান্তভাবে বললাম।


"জ্বি আলহামদুলিল্লাহ,আমিও ভালো আছি।"


তারপর আবারও কিছু সময়ের জন্য নীরবতা বিরাজ করল আমাদের মাঝে। এবার আমার সামনে বসা অপরিচিত মেয়েটাই নীরবতার দেয়ালটা ভেঙে বলল।


"আপনি কি আমিনুর রহমান?"


আমি বললাম।


"হ্যাঁ,আমি আমিনুর রহমান। কিন্তু আপনি কিভাবে আমার নাম জানেন?"


মেয়েটা বলল।


"শুনেছি খালা খালুর কাছ থেকে। যতদূর জানি আপনার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।"


আমি অবাক হলাম না। কারণ এর আগেও শুনেছি একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। যদিও আমার মতামত না জেনেই কাজটা করা হয়েছে। তাই মেয়ের মুখ থেকে নিজের বিয়ের কথা শুনে ওতটা বিচলিত হলাম না। বিচলিত না হয়ে সহজ ভাবেই মেয়েটাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে মারলাম।


"আপনি কি জানেন? কে আমি? কি আমার পরিচয়? আপনার খালা খালু আমার কি হয়?"


তখন মেয়েটা বলল।


"না জানার কি হলো? আপনি তাদের একমাত্র সন্তান। আমি তো এটাই জানি। তাদের কথা অনুযায়ী আপনি সহজসরল,নম্র ভদ্র খুব শান্ত একটা ছেলে।"


মেয়েটা কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম।


"আপনি জানেন তবে ভুল জানেন। আমি তাদের সন্তান ঠিকই তবে নিজের সন্তান না। বলতে পারেন সৎ ছেলে আর কি। মানে আমার বাবা আপনার খালাকে বিয়ে করেছেন। আর আমি মোটেও ভদ্র নই।"


আমার কথা শেষ হওয়ার পর মেয়েটা বলল।


"আপনি তাদের ছেলে এটাই সত্যি। সেটা আপন নাকি সৎ সেটা তো আমি জানি না। আর সৎ হলেই বা কি? আমার তো আপনাকে ভালো লেগেছে প্রথম দেখাতেই। যদিও একটু হাইট কম বাট আমার জন্য ঠিক আছে। আমার কোনো সমস্যা নেই আপনাকে বিয়ে করতে।"


আমি প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েটা সহজসরল শান্তশিষ্ট। কিন্তু এই কথাটা শোনার পরে মেয়েটাকে চরম বেহায়া মনে হচ্ছে আমার। কিভাবে পারে একটা অপরিচিত ছেলেকে সরাসরি এমন কথা বলতে? তাঁর কি লজ্জাশরম বলতে কিছু নেই নাকি। আমি কি বলব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে মেয়েটার মুখ থেকে এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না তাই যখন শুনলাম তখন কেনো জানি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। একটু পর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললাম।


"আমাকে আপনার কি দেখে পছন্দ হলো? দেখতে তো আহামরি না। ভালো কিছু করিও না,তাছাড়া আমি আপনাদের মতো শহরে মানুষ না,জন্মের পর থেকেই গ্রামে থেকেছি,সেখানেই বড় হয়েছি। তারপরও প্রথম দেখাতে আপনার মতো একটা মেয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য পছন্দ করে ফেলল। কেনো জানি এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। কোনো রহস্য টহস্য আছে নাকি?"


আমার কথাগুলোর প্রতিউত্তরে মেয়েটা বলল।


"আপনার চালচলন টা আমার ভালো লেগেছে। আপনার লাজুক চোখে কথা বলাটা আমার মনে ধরেছে। আমি ভেবেছিলাম আপনাকে আমার ভালো লাগবে না। গ্রামের একটা ছেলেকে ভালো লাগবে এমনটা আমার কখনোই মনে হয়নি। তারপরও খালার অনুরোধে এসেছিলাম। এসে ভালোই হয়েছে। আপনার কি আমাকে ভালো লাগে নি?"


মেয়েটার কথা যত শুনছি ততো অবাক হচ্ছি। সবকিছু যেনো মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ হচ্ছিলো মেয়েটাকে নিয়ে। এতো সুন্দর একটা মেয়ে প্রথম দেখাতেই চেনা নেই,জানা নেই অপরিচিত একটা ছেলেকে বিয়ে করার জন্য রাজী হয়ে গেলো? মেয়েটার কি খারাপ কোনো অতীত আছে নাকি? যে কারণে এতো তাড়াহুড়ো করে আমাকে পছন্দ করে ফেলল? ঢাকা শহরে এমন অনেক হয়। অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়েদের অতীত খুব খারাপ থাকে। অবশ্য যদিও সেগুলো গোপন থাকে,জানাজানি হয় না গ্রামের মতো। আমারও কেনো জানি মনে হলো মেয়েটার অতীতে হয়তো খারাপ কোনো কাহিনি আছে সেজন্য আমার মতো একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। আমি কল্পনার জগৎ থেকে নিজেকে বাস্তবে প্রতিস্থাপন করে মেয়েটাকে বললাম।


"ভালো লাগা খারাপ লাগার বিষয় না। আপনি যেমন ভেবেছেন আমি তেমন নই। হতে পারে বিয়ের পর আমি আপনাকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবে। যেখানে নেই কোনো বিলাসিতা,নেই কোনো আরাম আয়েশ। আমি অন্তত যাকে বিয়ে করব তাকে নিয়ে গ্রামেই থাকব। এই ইটপাথরের শহরটা আমার কাছে ভালো লাগে না। এখানে এসেছিলাম বড় কিছু করার আশায়। কিন্তু এখন মনে হয় এই যান্ত্রিক শহরের বিচিত্র জীবনের থেকে গ্রামের জীবন অনেকটা এগিয়ে। তারপরও থাকতে হচ্ছে। জানি না কতদিন থাকব। ঢাকা শহরের টাকাপয়সা ওয়ালা সুন্দরী একটা মেয়ে আমার মতো এমন তুচ্ছ একজন মানুষকে বিয়ে করে গ্রামে গিয়ে বসবাস করবে এমনটা তো আর আশা করা যায় না। কাজেই আমার আপনার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভাববেন না আমি আপনাকে অপছন্দ করে এটা বলেছি। আপনাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ আমার কাছে নেই। আমি যেভাবে জীবনযাপন করছি আসলে আমি মানুষটা এমন না।"


মেয়েটা বিস্মিত হয়ে বলল।


"তাহলে যে তারা বলল আপনি তাদের সাথেই থাকবেন বাকি জীবন। তারা কি আমাকে মিথ্যা বলেছে? আমি তো জানতাম আপনি ঢাকাতেই স্থায়ী হবেন। আর ঢাকা কি বসবাসের অযোগ্য নাকি যে আপনার এখানে ভালো লাগে না?"


আমি মেয়েটার কথাগুলো শুনে কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দিলাম।


"বসবাসের অযোগ্য কিনা জানি না তবে আমার ভালো লাগে না। এখানে মানুষের ভেদাভেদটা অনেক বেশি যেটা গ্রামে দেখা যায় না। আর আমার ঢাকাতে স্থায়ী হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। তারপরও কেনো তারা আপনাকে এটা বলেছে আমি জানি না৷ তবে হ্যাঁ এটা সত্যি তারা চায় আমি যেনো তাদের সাথে থাকি। সেজন্যই মূলত তাদের সাথে আছি তবে ভবিষ্যৎ থাকব এটার কোনো নিশ্চয়তা আমার কাছে নেই। আমি জীবনে অনেক মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছি,দুঃখ পেয়েছি। মানুষকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না আমার। সেটা নিজের বাবাকেও না। তাই তাঁর সাথে ভবিষ্যতে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আর আপনি বলেন তো,আপনার কি কোনো অতীত আছে? যেটা আপনি আমার কাছে লুকাচ্ছেন? না হলে ঢাকা শহরে এতো এতো ছেলে থাকতে আমার মতো একজন গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন কেনো?"


আমার শেষের কথাগুলো মেয়েটা হয়তো নিতে পারেনি। তাই মন খারাপ করে আমার সামনে থেকে চলে গেলো। আমারও কেমন যেনো অনুতপ্ত বোধ হলো। এভাবে বলা উচিত হয়নি। যে কারো অতীত থাকতেই পারে। আমারও তো একটা অতীত আছে। শুধুমাত্র হাইট কম ছিলো বলে আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেখানে এই মেয়েটা তো অনেক ভালো। আমি দেখতে ওতটা সুন্দর না,অনেক বেশি লম্বাও না,টাকাপয়সাও নেই। তারপরও বিয়ে করতে চাচ্ছে আমাকে। অন্তত ইসরাতের থেকে এই মেয়েটার মনমানসিকতা অনেক ভালো। আমার এমন বলা উচিত হয়নি। শুধুশুধু হাসিখুশি একটা মেয়ের মনখারাপের কারণ হলাম।


কয়েকদিন পরের ঘটনা,

নাদিয়ার কোনো এক আত্মীয়ের বিয়ে ছিলো সেদিন। নাদিয়া আমাকে ডেকে বলল।


"আপনার যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। আমার খুব কাছের একটা আত্মীয়ের আজকে বিয়ে। আপনি যদি সেখানে আমার সাথে যেতেন তাহলে আমার ভালো লাগত। আসলে একা একা একটা বিয়ে বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না তাই আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। তবে আপনার যদি সময় না হয় তাহলে জোর করবো না। তবে আপনি যদি আমার সাথে আসেন তাহলে আমি খুব খুশি হবো।"


আমার এমনিতেই মানুষের সোরগোল ভালো লাগে না। কেনো জানি জনমানবশূন্য স্থানই আমার ভালো লাগে। বেশি মানুষের মাঝে গেলে আমি যে অসুন্দর এই জিনিসটা বারবার মনে পড়ে। আশেপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকালে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। চলাফেরা,আচার-আচরণে,কথাবার্তায়,চেহারায় সবদিক থেকে আমি খুব খুব সাধারণ একজন মানুষ। তাই হয়তো এমন মনে হয়। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এসব মানুষেরা বেশি মানুষদের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। তারা একাকিত্ব জীবনটা বড্ড পছন্দ করে। সুন্দর মানুষেরা যেমন বেশি মানুষের মাঝে থাকতে পছন্দ কর,অসুন্দর মানুষেরা তেমনই একাকিত্ব পছন্দ করে। আমিও একাকিত্ব পছন্দ করি। কিন্তু নাদিয়া মেয়েটার কথা চিন্তা করে তাঁর সাথে বিয়ে বাড়িতে যেতে হলো। সেদিন আমার কারণে মেয়েটার সুন্দর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিলো। তাই আজকে তাঁর এই অনুরোধটা না রেখে পারলাম না। শুধুমাত্র তাকে খুশি করার জন্য তাঁর সাথে বিয়ে বাড়িতে গেলাম।

জীবন সংগ্রাম পর্ব - ৩ 

সবশেষ বিয়ে বাড়িতে গেলাম সেটাও কয়েকদিনের পরিচিত একটা মেয়েকে নিয়ে। নাদিয়ার গাড়ি থাকা সত্ত্বেও আমার সাথে রিকশা করে কেনো গেলো সেটা বুঝতে পারলাম না। আমি জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে রিকশায় চড়লাম। ইসরাতের সাথেও কখনো পাশাপাশি বসে রিকশা করে ঘোরা হয়নি। অথচ যাকে ভালোভাবে চিনি না,জানি না তাঁর সাথে তাঁর পাশে বসে রিকশা করে করে ঘুরছি। এটাই হয়তো জীবন। অনেকদিনের পরিচিত মানুষকে অনেক সময় বলা হয়ে উঠে না আপনাকে আমার ভালো লাগে। আবার অপরিচিত একটা মানুষকে হঠাৎ করেই বলে দিতে ইচ্ছে করে আপনাকে আমার ভালো লাগে। জীবন বড়ই বিচিত্র,কার জীবনে কখন কি হয় আমরা কেউ বলতে পারি না।


বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পরে যেটা হওয়ার ছিলো না সেটাই হলো। এমনিতেই এমন একটা সুন্দরী মেয়ের পাশে নিজেকে নিয়ে খুব অস্বস্থিবোধ করছিলাম। আশেপাশের মানুষগুলো কিভাবে যেনো তাকাচ্ছিলো। তাদের তাকানো দেখে মনে হচ্ছিলো সুন্দর মানুষের পাশে সুন্দর মানুষকেই মানায়,অথচ আমি সৌন্দর্যের দিক থেকে নাদিয়ার ধারেকাছেও নেই। তার ওপর আবার ইসরাতের সাথে দেখা হয়ে গেলো। ইসরাত যে আমাকে এরকম একটা সুন্দরী মেয়ের পাশে এখানে দেখে অনেক বেশি অবাক হয়েছে সেটা তাঁর চোখমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কারণ সে কখনো চিন্তায় করেনি আমি তাঁর থেকেও সুন্দরী কোনো মেয়ের পাশে নিজেকে দাড়া করাতে পারব। 


চলবে..................

পর্ব_৪

জীবন_সংগ্রাম

আমিনুর রহমান